ইতিবাচক বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী মুখ সাকিব আল হাসান। তাঁর পারফরম্যান্সের আলোকরশ্মি চোখ ধাঁধিয়ে আসছে অনেক দিন ধরেই। তবে এবার যে কীর্তিটা করলেন তাতে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটে যেমন সবচেয়ে বেশি রান তাঁর তেমনি বল হাতেও নিয়েছেন সবচেয়ে বেশি উইকেট! যুগে যুগে গ্যারি সোবার্স, ইমরান খান, ইয়ান বোথাম, জ্যাক ক্যালিস, কপিল দেবের মতো কিংবদন্তি অলরাউন্ডার এসেছেন অনেক। তাঁদের কেউই পারেননি নিজ দেশের হয়ে একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ রানের চূড়ায় উঠতে। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসেই একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে এখন কীর্তিটা সাকিবের।
ক্রিকেটে পরিসংখ্যানকে ‘গাধা’ বলে গালাগাল করেন অনেকে। তার পরও এই পরিসংখ্যান সামর্থ্যেরই আয়না। ডন ব্র্যাডম্যানের টেস্ট গড় ১০০ ছুঁই ছুঁই আর শচীন টেন্ডুলকারের আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি একশটা বলেই তো সর্বকালের সেরা তাঁরা। সেই খটমটে পরিসংখ্যানই সাকিবকে নিয়ে গেল অনন্য চূড়ায়। কীর্তিটা হয়েছে ২৭তম জন্মদিনের সপ্তাহখানেক আগে। বিশ্ব টি-টোয়েন্টিতে নেপালের বিপক্ষে অপরাজিত ৩৭ রানের ইনিংসে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানে পরিণত হন তিনি। এত দিন টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৬৬৫৫ রান ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের (টেস্ট রান ২৭৩৭, ওয়ানডে ৩৪৬৮ ও টি-টোয়েন্টিতে ৪৫০)। ১৮ মার্চ চট্টগ্রামের ইনিংসটির পর সাকিবের রান বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬৭০।
হংকংয়ে বিপক্ষে পরের ম্যাচে ৩৪ রানের আরেকটি ইনিংসে রানটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭০৪-এ। সাত হাজার ছুঁই ছুঁই রানের মধ্যে সাকিবের টেস্ট রান ২২৭৮, ওয়ানডেতে ৩৩৭৯ আর টি-টোয়েন্টিতে ৬৪৭। আর উইকেট নেওয়ায় তো অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের সেরা তিনি। টেস্টে ১২২, ওয়ানডেতে ১৬৫ ও টি-টোয়েন্টির ৪৩ মিলিয়ে তাঁর সম্মিলিত আন্তর্জাতিক উইকেট ৩৩০। বুঝতেই পারছেন ব্যাট-বল সবেতেই হীরকখণ্ডের দ্যুতি। কোনো দেশের হয়ে একই সঙ্গে উইকেট আর রানের এভারেস্টে চড়েই যে সর্বকালের সেরা হয়ে গেছেন সাকিব, ব্যাপারটা তা নয়। তবে অন্তত এই একটা দিক দিয়ে সোবার্স, ইমরান, ক্যালিসদের পেছনে ফেলাটা অনিন্দ্য সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।
নিজের দেশের হয়ে একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি রান আর উইকেট নেওয়ার লড়াইয়ে সাকিবের কাছাকাছি ছিলেন জ্যাক ক্যালিস। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে এই কিংবদন্তি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন সবচেয়ে বেশি ২৫৫২৯ রান (টেস্টে ১৩২৮৯, ওয়ানডেতে ১১৫৭৪ ও টি-টোয়েন্টিতে ৬৬৬)। কিন্তু উইকেট নেওয়ার বেলায় ক্যালিস অনেক পিছিয়ে শন পোলকের চেয়ে। ৮২৯ শিকারে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শন পোলকের (টেস্ট ৪২১, ওয়ানডে ৩৯৩ আর টি-টোয়েন্টিতে ১৫ উইকেট)। সেখানে ক্যালিসের আন্তর্জাতিক উইকেট ৫৭৭টি (টেস্ট ২৯২, ওয়ানডে ২৭৩ আর টি-টোয়েন্টিতে ১২)।
সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে অনেকেই নাম নেন স্যার গ্যারি সোবার্সের। একটি ট্রিপলসহ ২৬ সেঞ্চুরি আর ৫০ ফিফটিতে তাঁর টেস্ট রান ৮০৩২। একটা মাত্র ওয়ানডে খেলে দেখা পাননি রানের, উইকেট পেয়েছিলেন ১টি। আর ৯৩ টেস্টে পেয়েছেন ২৩৫ উইকেট। তবে ক্যারিবিয়ানদের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান বা উইকেট নেওয়ার দৌড়ে যোজন যোজন মাইল পেছনে সোবার্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ২২৩৫৮ রান ‘প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ’ ব্রায়ান লারার (টেস্টে ১১৯৫৩, ওয়ানডেতে ১০৪০৫)। সেখানে সোবার্সের রান লারার তুলনায় প্রায় তিন ভাগের একভাগ ৮০৩২। তেমনি আন্তর্জাতিক উইকেটেও কোর্টনি ওয়ালশের ৭৪৬-এর বিপরীতে (টেস্টে ৫১৯, ওয়ানডেতে ২২৭) সোবার্সের শিকার ২৩৬টি।
সোবার্সের মতো কপিল দেবও ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ রান বা উইকেট নেওয়া ক্রিকেটার নন। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিলের আন্তর্জাতিক রান ৯০৩১ (টেস্টে ৫২৪৮, ওয়ানডেতে ৩৭৮৩) ও উইকেট ৬৮৭টি (টেস্টে ৪৩৪, ওয়ানডেতে ২৫৩)। শুধু ভারত নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ৩৪৩৫৭ রান শচীন টেন্ডুলকারের (টেস্টে ১৫৯২১, ওয়ানডেতে ১৮৪২৬ ও টি-টোয়েন্টিতে ১০)। ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার সিংহাসনে আসীন অনিল কুম্বলে। তাঁর আন্তর্জাতিক উইকেট ৯৫৬ (টেস্টে ৬১৯, ওয়ানডেতে ৩৩৭)।
পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার ইমরান খান বা হালের শহীদ আফ্রিদিও নিজের দেশের হয়ে একই সঙ্গে সর্বোচ্চ উইকেট বা রান করা ক্রিকেটার নন। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরানের আন্তর্জাতিক রান ৭৫১৬ (টেস্টে ৩৮০৭, ওয়ানডে ৩৭০৯) ও উইকেট ৫৪৪টি (টেস্টে ৩৬২, ওয়ানডেতে ১৮২)। ‘বুম বুম’ আফ্রিদির আন্তর্জাতিক রান ১০৪০৭(টেস্টে ১৭১৬, ওয়ানডেতে ৭৬১৯, টি-টোয়েন্টিতে ১০৭২) ও উইকেট ৫০১টি (টেস্টে ৪৮, ওয়ানডেতে ৩৭৮, টি-টোয়েন্টিতে ৭৫)। জ্যাক ক্যালিসের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন ১০ হাজার রান ও ৫০০ উইকেটের বিরল কীর্তিও। তবে পাকিস্তানের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান ইনজামাম-উল হকের ২০৫৮০ (টেস্টে ৮৮৩০, ওয়ানডেতে ১১৭৩৯, টি-টোয়েন্টিতে ১১) আর সবচেয়ে বেশি উইকেট ওয়াসিম আকরামের ৯১৬টি (টেস্টে ৪১৪ ওয়ানডেতে ৫০২)।
৫৮৯ আন্তর্জাতিক উইকেট নেওয়া স্যার রিচার্ড হ্যাডলিকে (টেস্টে ৪৩১, ওয়ানডেতে ১৫৮) অনেক আগেই পেছনে ফেলেছেন ড্যানিয়েল ভেট্টরি। এই বাঁ-হাতি অলরাউন্ডারেরই নিউজল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক উইকেট সবচেয়ে বেশি ৬৮১টি (টেস্টে ৩৬০, ওয়ানডেতে ২৮৪, টি-টোয়েন্টিতে ৩৭)। সেই সঙ্গে ৬৮৩১ আন্তর্জাতিক রান করায় সাকিবের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারতেন তিনিও। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ১৫৩১৯ রানের কীর্তিটা স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের (টেস্টে ৭১৭২, ওয়ানডেতে ৮০৩৭, টি-টোয়েন্টিতে ১১০)। সাকিবের কাতারে তাই আসা হয়নি ভেট্টরিরও।
ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেটের লড়াইয়ে কাছাকাছি থাকলেও রানের রেসে অনেক পিছিয়ে ইয়ান বোথাম। জেমস অ্যান্ডারসনের ৬০৬ আন্তর্জাতিক উইকেটের (টেস্টে ৩৪৩, ওয়ানডেতে ২৪৫, টি-টোয়েন্টিতে ১৮) বিপরীতে বোথামের উইকেট ৫২৮টি (টেস্টে ৩৮৩, ওয়ানডেতে ১৪৫)। তবে বোথামের রান যেখানে ৭৩১৩ (টেস্টে ৫২০০, ওয়ানডেতে ২১১৩) সেখানে ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান করা কেভিন পিটারসেনের সংগ্রহ ১৩৭৯৭ (টেস্টে ৮১৮১, ওয়ানডেতে ৪৪৪০, টি-টোয়েন্টিতে ১১৭৬)।
সাকিবের মতো দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান ও উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়ার হাতছানি ছিল শ্রীলঙ্কার সনৎ জয়াসুরিয়ারও। কিন্তু মুত্তিয়া মুরালিধরন আর কুমার সাঙ্গাকারার মতো দুই কিংবদন্তির জন্য হয়নি সেটা। ২১ হাজারের বেশি রান করে জয়াসুরিয়া তাই যেমন শ্রীলঙ্কার হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যান নন, তেমনি ৪৪০ উইকেট নিয়েও তিনি পিছিয়ে মুরালিধরনের চেয়ে। ‘মাতারা হারিকেন’ খ্যাত জয়াসুরিয়ার আন্তর্জাতিক রান ২১০৩২ (টেস্টে ৬৯৭৩, ওয়ানডেতে ১৩৪৩০, টি-টোয়েন্টিতে ৬২৯) ও উইকেট ৪৪০টি (টেস্টে ৯৮, ওয়ানডেতে ৩২৩, টি-টোয়েন্টিতে ১৯)। লঙ্কানদের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান কুমার সাঙ্গাকারার ২৪৯৭৬ (টেস্টে ১১১৫১, ওয়ানডেতে ১২৫০০, টি-টোয়েন্টিতে ১৩২৫)। মুত্তিয়া মুরালিধরন আন্তর্জাতিক উইকেট নিয়েছেন ১৩৪৭টি (টেস্টে ৮০০, ওয়ানডেতে ৫৩৪, টি-টোয়েন্টিতে ১৩)। শ্রীলঙ্কার হয়ে তো বটেই মুরালির চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক উইকেট নেই আর কারোই।
মুরালিধরনের পর একমাত্র বোলার হিসেবে আন্তর্জাতিক ১০০০ উইকেটের কীর্তি অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্নের। মায়াবী ঘূর্ণিতে এই লেগ স্পিনারের শিকার ১০০১ উইকেট (টেস্টে ৭০৮, ওয়ানডেতে ২৯৩)। ক্রিকেটের প্রাচীন আর সবচেয়ে সফল এই দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ২৭৪৮৩ আন্তর্জাতিক রান রিকি পন্টিংয়ের (টেস্টে ১৩৩৭৮, ওয়ানডেতে ১৩৭০৪, টি-টোয়ন্টিতে ৪০১)। পন্টিং বা ওয়ার্নকে একই সঙ্গে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো অলরাউন্ডার কিন্তু ছিল না অস্ট্রেলিয়ার। তেমনি একই সঙ্গে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হিথ স্ট্রিককে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো ক্রিকেটার ছিল না জিম্বাবুয়েরও। নিজেদের ছায়া হয়ে পড়া জিম্বাবুয়ের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ১১৫৮০ (টেস্টে ৪৭৯৪, ওয়ানডেতে ৬৭৮৬) আর উইকেট হিথ স্ট্রিকের ৪৫৫টি (টেস্টে ২১৬ ওয়ানডেতে ২৩৯)।
অর্থাৎ অন্তত এই একটি দিক দিয়ে অনন্য সাকিব আল হাসান। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান আর উইকেট নিয়ে অবশ্য সর্বকালের সেরা হয়ে যাবেন না। তবে এই কীর্তিতে যুগে যুগে আসা কিংবদন্তির ভিড়েও জ্বলজ্বল করবেন ঠিকই।
ক্রিকেটে পরিসংখ্যানকে ‘গাধা’ বলে গালাগাল করেন অনেকে। তার পরও এই পরিসংখ্যান সামর্থ্যেরই আয়না। ডন ব্র্যাডম্যানের টেস্ট গড় ১০০ ছুঁই ছুঁই আর শচীন টেন্ডুলকারের আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি একশটা বলেই তো সর্বকালের সেরা তাঁরা। সেই খটমটে পরিসংখ্যানই সাকিবকে নিয়ে গেল অনন্য চূড়ায়। কীর্তিটা হয়েছে ২৭তম জন্মদিনের সপ্তাহখানেক আগে। বিশ্ব টি-টোয়েন্টিতে নেপালের বিপক্ষে অপরাজিত ৩৭ রানের ইনিংসে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানে পরিণত হন তিনি। এত দিন টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ৬৬৫৫ রান ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের (টেস্ট রান ২৭৩৭, ওয়ানডে ৩৪৬৮ ও টি-টোয়েন্টিতে ৪৫০)। ১৮ মার্চ চট্টগ্রামের ইনিংসটির পর সাকিবের রান বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬৭০।
হংকংয়ে বিপক্ষে পরের ম্যাচে ৩৪ রানের আরেকটি ইনিংসে রানটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭০৪-এ। সাত হাজার ছুঁই ছুঁই রানের মধ্যে সাকিবের টেস্ট রান ২২৭৮, ওয়ানডেতে ৩৩৭৯ আর টি-টোয়েন্টিতে ৬৪৭। আর উইকেট নেওয়ায় তো অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের সেরা তিনি। টেস্টে ১২২, ওয়ানডেতে ১৬৫ ও টি-টোয়েন্টির ৪৩ মিলিয়ে তাঁর সম্মিলিত আন্তর্জাতিক উইকেট ৩৩০। বুঝতেই পারছেন ব্যাট-বল সবেতেই হীরকখণ্ডের দ্যুতি। কোনো দেশের হয়ে একই সঙ্গে উইকেট আর রানের এভারেস্টে চড়েই যে সর্বকালের সেরা হয়ে গেছেন সাকিব, ব্যাপারটা তা নয়। তবে অন্তত এই একটা দিক দিয়ে সোবার্স, ইমরান, ক্যালিসদের পেছনে ফেলাটা অনিন্দ্য সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।
নিজের দেশের হয়ে একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি রান আর উইকেট নেওয়ার লড়াইয়ে সাকিবের কাছাকাছি ছিলেন জ্যাক ক্যালিস। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে এই কিংবদন্তি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন সবচেয়ে বেশি ২৫৫২৯ রান (টেস্টে ১৩২৮৯, ওয়ানডেতে ১১৫৭৪ ও টি-টোয়েন্টিতে ৬৬৬)। কিন্তু উইকেট নেওয়ার বেলায় ক্যালিস অনেক পিছিয়ে শন পোলকের চেয়ে। ৮২৯ শিকারে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শন পোলকের (টেস্ট ৪২১, ওয়ানডে ৩৯৩ আর টি-টোয়েন্টিতে ১৫ উইকেট)। সেখানে ক্যালিসের আন্তর্জাতিক উইকেট ৫৭৭টি (টেস্ট ২৯২, ওয়ানডে ২৭৩ আর টি-টোয়েন্টিতে ১২)।
সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে অনেকেই নাম নেন স্যার গ্যারি সোবার্সের। একটি ট্রিপলসহ ২৬ সেঞ্চুরি আর ৫০ ফিফটিতে তাঁর টেস্ট রান ৮০৩২। একটা মাত্র ওয়ানডে খেলে দেখা পাননি রানের, উইকেট পেয়েছিলেন ১টি। আর ৯৩ টেস্টে পেয়েছেন ২৩৫ উইকেট। তবে ক্যারিবিয়ানদের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান বা উইকেট নেওয়ার দৌড়ে যোজন যোজন মাইল পেছনে সোবার্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ২২৩৫৮ রান ‘প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ’ ব্রায়ান লারার (টেস্টে ১১৯৫৩, ওয়ানডেতে ১০৪০৫)। সেখানে সোবার্সের রান লারার তুলনায় প্রায় তিন ভাগের একভাগ ৮০৩২। তেমনি আন্তর্জাতিক উইকেটেও কোর্টনি ওয়ালশের ৭৪৬-এর বিপরীতে (টেস্টে ৫১৯, ওয়ানডেতে ২২৭) সোবার্সের শিকার ২৩৬টি।
সোবার্সের মতো কপিল দেবও ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ রান বা উইকেট নেওয়া ক্রিকেটার নন। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিলের আন্তর্জাতিক রান ৯০৩১ (টেস্টে ৫২৪৮, ওয়ানডেতে ৩৭৮৩) ও উইকেট ৬৮৭টি (টেস্টে ৪৩৪, ওয়ানডেতে ২৫৩)। শুধু ভারত নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ৩৪৩৫৭ রান শচীন টেন্ডুলকারের (টেস্টে ১৫৯২১, ওয়ানডেতে ১৮৪২৬ ও টি-টোয়েন্টিতে ১০)। ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার সিংহাসনে আসীন অনিল কুম্বলে। তাঁর আন্তর্জাতিক উইকেট ৯৫৬ (টেস্টে ৬১৯, ওয়ানডেতে ৩৩৭)।
পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার ইমরান খান বা হালের শহীদ আফ্রিদিও নিজের দেশের হয়ে একই সঙ্গে সর্বোচ্চ উইকেট বা রান করা ক্রিকেটার নন। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরানের আন্তর্জাতিক রান ৭৫১৬ (টেস্টে ৩৮০৭, ওয়ানডে ৩৭০৯) ও উইকেট ৫৪৪টি (টেস্টে ৩৬২, ওয়ানডেতে ১৮২)। ‘বুম বুম’ আফ্রিদির আন্তর্জাতিক রান ১০৪০৭(টেস্টে ১৭১৬, ওয়ানডেতে ৭৬১৯, টি-টোয়েন্টিতে ১০৭২) ও উইকেট ৫০১টি (টেস্টে ৪৮, ওয়ানডেতে ৩৭৮, টি-টোয়েন্টিতে ৭৫)। জ্যাক ক্যালিসের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন ১০ হাজার রান ও ৫০০ উইকেটের বিরল কীর্তিও। তবে পাকিস্তানের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান ইনজামাম-উল হকের ২০৫৮০ (টেস্টে ৮৮৩০, ওয়ানডেতে ১১৭৩৯, টি-টোয়েন্টিতে ১১) আর সবচেয়ে বেশি উইকেট ওয়াসিম আকরামের ৯১৬টি (টেস্টে ৪১৪ ওয়ানডেতে ৫০২)।
৫৮৯ আন্তর্জাতিক উইকেট নেওয়া স্যার রিচার্ড হ্যাডলিকে (টেস্টে ৪৩১, ওয়ানডেতে ১৫৮) অনেক আগেই পেছনে ফেলেছেন ড্যানিয়েল ভেট্টরি। এই বাঁ-হাতি অলরাউন্ডারেরই নিউজল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক উইকেট সবচেয়ে বেশি ৬৮১টি (টেস্টে ৩৬০, ওয়ানডেতে ২৮৪, টি-টোয়েন্টিতে ৩৭)। সেই সঙ্গে ৬৮৩১ আন্তর্জাতিক রান করায় সাকিবের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারতেন তিনিও। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ১৫৩১৯ রানের কীর্তিটা স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের (টেস্টে ৭১৭২, ওয়ানডেতে ৮০৩৭, টি-টোয়েন্টিতে ১১০)। সাকিবের কাতারে তাই আসা হয়নি ভেট্টরিরও।
ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেটের লড়াইয়ে কাছাকাছি থাকলেও রানের রেসে অনেক পিছিয়ে ইয়ান বোথাম। জেমস অ্যান্ডারসনের ৬০৬ আন্তর্জাতিক উইকেটের (টেস্টে ৩৪৩, ওয়ানডেতে ২৪৫, টি-টোয়েন্টিতে ১৮) বিপরীতে বোথামের উইকেট ৫২৮টি (টেস্টে ৩৮৩, ওয়ানডেতে ১৪৫)। তবে বোথামের রান যেখানে ৭৩১৩ (টেস্টে ৫২০০, ওয়ানডেতে ২১১৩) সেখানে ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান করা কেভিন পিটারসেনের সংগ্রহ ১৩৭৯৭ (টেস্টে ৮১৮১, ওয়ানডেতে ৪৪৪০, টি-টোয়েন্টিতে ১১৭৬)।
সাকিবের মতো দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান ও উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়ার হাতছানি ছিল শ্রীলঙ্কার সনৎ জয়াসুরিয়ারও। কিন্তু মুত্তিয়া মুরালিধরন আর কুমার সাঙ্গাকারার মতো দুই কিংবদন্তির জন্য হয়নি সেটা। ২১ হাজারের বেশি রান করে জয়াসুরিয়া তাই যেমন শ্রীলঙ্কার হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যান নন, তেমনি ৪৪০ উইকেট নিয়েও তিনি পিছিয়ে মুরালিধরনের চেয়ে। ‘মাতারা হারিকেন’ খ্যাত জয়াসুরিয়ার আন্তর্জাতিক রান ২১০৩২ (টেস্টে ৬৯৭৩, ওয়ানডেতে ১৩৪৩০, টি-টোয়েন্টিতে ৬২৯) ও উইকেট ৪৪০টি (টেস্টে ৯৮, ওয়ানডেতে ৩২৩, টি-টোয়েন্টিতে ১৯)। লঙ্কানদের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান কুমার সাঙ্গাকারার ২৪৯৭৬ (টেস্টে ১১১৫১, ওয়ানডেতে ১২৫০০, টি-টোয়েন্টিতে ১৩২৫)। মুত্তিয়া মুরালিধরন আন্তর্জাতিক উইকেট নিয়েছেন ১৩৪৭টি (টেস্টে ৮০০, ওয়ানডেতে ৫৩৪, টি-টোয়েন্টিতে ১৩)। শ্রীলঙ্কার হয়ে তো বটেই মুরালির চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক উইকেট নেই আর কারোই।
মুরালিধরনের পর একমাত্র বোলার হিসেবে আন্তর্জাতিক ১০০০ উইকেটের কীর্তি অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্নের। মায়াবী ঘূর্ণিতে এই লেগ স্পিনারের শিকার ১০০১ উইকেট (টেস্টে ৭০৮, ওয়ানডেতে ২৯৩)। ক্রিকেটের প্রাচীন আর সবচেয়ে সফল এই দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ২৭৪৮৩ আন্তর্জাতিক রান রিকি পন্টিংয়ের (টেস্টে ১৩৩৭৮, ওয়ানডেতে ১৩৭০৪, টি-টোয়ন্টিতে ৪০১)। পন্টিং বা ওয়ার্নকে একই সঙ্গে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো অলরাউন্ডার কিন্তু ছিল না অস্ট্রেলিয়ার। তেমনি একই সঙ্গে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হিথ স্ট্রিককে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো ক্রিকেটার ছিল না জিম্বাবুয়েরও। নিজেদের ছায়া হয়ে পড়া জিম্বাবুয়ের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ১১৫৮০ (টেস্টে ৪৭৯৪, ওয়ানডেতে ৬৭৮৬) আর উইকেট হিথ স্ট্রিকের ৪৫৫টি (টেস্টে ২১৬ ওয়ানডেতে ২৩৯)।
অর্থাৎ অন্তত এই একটি দিক দিয়ে অনন্য সাকিব আল হাসান। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক রান আর উইকেট নিয়ে অবশ্য সর্বকালের সেরা হয়ে যাবেন না। তবে এই কীর্তিতে যুগে যুগে আসা কিংবদন্তির ভিড়েও জ্বলজ্বল করবেন ঠিকই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন